শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:ফকির লালন শাহ’র বিশ্বাস, মানুষকে ভালোবাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়। তদ্রুপ মানুষকে ভজনা করলে স্রষ্টাকে ভজনা করা হয়। যিনি পরমাত্মা তিনিই ঈশ্বর, তিনিই আল্লাহ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তিনি একজন। সেই একজন মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন। মানুষ ভজলেই অটল রূপের মনের মানুষের সন্ধান মেলে। মানুষকে নিয়েই যত গান। সে কারণে তিনি সব ধরনের সাধনসিদ্ধির জন্য মানুষগুরুর প্রতি নিষ্ঠাবান হতে বলেছেন।
সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে॥
ভজ মানুষের চরণ দুটি
নিত্য বস্তু পাবি খাঁটি॥
ফকির লালন সাঁই তার গানের আড়ালে যে সুচিন্তিত বক্তব্য এবং গূঢ়তাত্ত্বিক বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছেন আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লালন সাঁই তার দীর্ঘ ১১৬ বছরের জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান। তাঁর গানে আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং সূক্ষ্ম অথচ তীর্যক উপমা উপস্থাপন করেছেন। ধর্ম কিংবা ঈশ্বর লালন বিশ্বাস করতেন এটি যেমন সত্য তেমনি সত্য তার মতে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। যার কারণে চন্ডীদাসের অমর বাণীর (‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’) মতো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তার গানে। তিনি কখনই জাতিত্বের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জাতির এবং জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আলাদা এবং অকর্মণ্য এবং কূপমন্ডুক করে রাখে। তার গানে এসব প্রতিফলন স্পষ্ট এবং অসম্ভব তীব্রতরÑ
জাত না গেলে পাইনে হরি
কিছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে।
জাতের বিপক্ষে এ রকম তীব্র বাণী লালন করেছিলেন গানের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ তাকে অসম্ভব যাতনা দিয়েছিল সেটি উক্ত অংশ প্রমাণ করে।
গানের পর্ব থেকেই লালন সমাজ সংস্করণের মহান দায়িত্ব গ্রহণ না করলেও চেতনা সংস্করণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত গুরুবাদী লালন সাঁই আধ্যাত্মবাদিতা থেকে শুরু করে ভক্তিবাদ, হিন্দু-মুসলিম পুরাণ পর্যন্ত তুলে ধরেছেন তার গানে। স্বামী বিবেকানন্দের মতো লালন সাঁই সৃষ্টির সেবায় ঈশ্বর সেবা চেয়েছেন। আবার তিনি পুঁথিগত ঈশ্বর চাননি চেয়েছেন নিরাকার ঈশ্বর।
টলে জীব অটলে ঈশ্বর
তাতে কি হয় রসিক শিখর
লালন বলে রসে বিভোর
রস ভিয়ানে॥
দ্বন্ধ-সংঘাতময় বিশ্বে এবং অবক্ষয়ে ক্ষয়িষ্ণু সমাজে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার অভাবই যে বড় সংকট, লালন সাঁইয়ের সঙ্গীত সেই বার্তা পৌছে দিয়েছে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’; যে বাণী এখনও প্রাসঙ্গিক।
‘এই মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার।
লালন বলে মানুষ আকার
ভজলে তারে পাবি’-
ধর্মচেতনা মধ্যযুগীয় মরমী সাধকদের যেরূপ আশ্রয় দিয়েছিল লালন সাঁইও তাদের একজন। লালন ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তার কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান। মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক কিংবা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অন্যতম সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তার সাধনার মূলমন্ত্র ‘আত্মং বিদ্ধিং’। যার অর্থ ‘নিজেকে চেন’। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সে আত্মাকে কেউ স্পর্শ করেনি কিংবা মানবচক্ষে দেখতে পায়নি। লালন তার গানে এ ভাবধারাই প্রকাশ করলেন
বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা
এক পড়শি বসত করে
আমি একদিন না দেখিলাম তারে॥
আবার ধর্মান্ধদের পথ প্রদর্শনের বিষয়টিকে লালন তীব্রভাবেই কটাক্ষ করেছেন তার গানে। তার মতবাদ অনুযায়ী ‘দুই কানা’ বাস করে। পৃথিবীতে যারা নিজেরা কিছু না চিনলেও অপরকে ঠিকই নিজেদের দিকে টানাটানি করে। তাই তো লালন বলেন
এসব দেখি কানার হাটবাজার
বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানা আর এক কানা মন আমার
সত্যিই লালনকে সন্ধান করতে গেলে ফাঁপরে পড়তে হয়। কে এই লালন, কী তাঁর জাত পরিচয় অথবা কেমন তাঁর ধর্ম-জীবনপ্রণালী, প্রশ্ন জাগে। মানুষের মতামতের যেমন শেষ নেই, তেমনি গবেষকরাও তাঁর সব বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। অথচ ১২৮ বছর আগের দেহত্যাগী লালনের একজোড়া গুরু-শিষ্যকে ধরে নেমে এলেই জীবিত বাউলের দেখা মেলে। যেহেতু বাউলবাদ গুরুবাদী, সেহেতু গুরু-শিষ্যের সরেজমিন কথোপকথন, জীবন, যৌনাচার সবকিছুর বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যাবে সম্যক লালন ও তাঁর দর্শনকে। দেশময় ছড়িয়ে থাকলেও বাউলদের মন পড়ে থাকে লালনের বারামখানায়। নানা ছুঁতোয় তাঁরা চলে আসেন মনতীর্থে। দোল কিংবা কার্তিক হলে তো কথাই নেই। ফকির লালন সমকালে যেমন শিষ্যদের নিয়ে ফাগুনের পূর্ণিমায় মচ্ছব করতেন, তেমন করে প্রতি বছর মচ্ছব বসে আখড়াবাড়িতে। ১৮৯০ সালের পয়লা কার্তিকে লালন গত হওয়ার পর থেকে দোলের সঙ্গে স্মরণোৎসবও যোগ হয় মচ্ছবানন্দে। পরম্পরায় বয়ে চলেছে এ ধারা। কার্তিক এলেই আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদনৃত্যে ভারি হয়ে ওঠে সাধুবাজার। গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে শুরু হয় ভাবের খেলা। ভাবজগতের মধ্যে বেজে ওঠে তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে। একতারা, দোতরা, ঢোলখোল, হারমোনি, বাঁশি, জোয়ারি, চাকতি, খমক হাতে একযোগে বাউলরা উড়াল তোলে। শোক বিয়োগের দিন হলেও ভক্তভারে ক্রমেই দৃশ্যগুলো তখন পাল্টে যেতে শুরু করে। খন্ড খন্ড মজমা থেকে তালের উন্মাদনায় দমকে দমকে ভাসতে থাকে ভাববাদী ঢেউ। স্মরণোৎসব শোকাচ্ছন্ন থাকে না, উল্টো আনন্দময় মচ্ছবে পরিণত হয়। দুটো বড় আয়োজন বাদেও প্রায় প্রতিদিনই সাধু-গুরুদের বাজার বসে আখড়াবাড়িতে।
লালনের গানে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে তার দর্শনের যে প্রতিফলন দেখা যায় তা দেশকালের গ-ি ছাড়িয়ে বিশ্বমানবিক মূল্যবোধের পরিচয় তুলে ধরে। লালন তাই কেবল বাঙ্গালি মরমী কবি বা গীতিকবিদের গ-িতে আবদ্ধ নন, বিশ্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গনেও তার অবস্থান অনেক উঁচুতে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে জাত-ধর্মের বাহ্যিক আচরণ ও ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লালন ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার গান জাত-পাতের বিরুদ্ধে মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়। গানে তিনি বলছেন:
‘একই ঘাটে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া
কেউ খায় না কারও ছোঁয়া বিভিন্ন জল কে কোথায় পান’
মানবতাবাদ শব্দটির মর্মকথা হচ্ছে মানবতন্ত্র, মানুষ ও তার কর্ম অর্থাৎ ‘মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি’। লালন মানবীয় বিচ্যুতির সব সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা-মোহ-হিংসা-দ্বেষ বর্জন করে, কেবল মানুষের সম্প্রীতির বাণীই তাঁর গানে প্রচার করেছেন। সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুল্য-মূল্যে বিচার চলে এমন মানুষ পৃথিবীতে খুবই বিরল। বাঙালির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান লালন আজ বিশ্বসমাজের মহান আদর্শ, পবিত্র প্রতীক-প্রতিমা, আর মানবতাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে লালন আজ মহান আইকন। তবে তাঁর মানবতাবাদী চিন্তার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের মনীষী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দু’জন রাজনৈতিক রূপকার মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা চলে। রবীন্দ্রনাথের কাছে মানুষের ধর্ম বলতে ছিল মানুষের মঙ্গল চিন্তা; বঙ্গবন্ধু ধর্মকে দেখেছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ হিসেবে। আর গান্ধীর অহিংসার বাণী বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তনের ওপর যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে তাও আমাদের অমূল্য পাওয়া। সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ ও সামাজিক বৈষম্যে ক্ষতবিক্ষত বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-মুজিবের অহিংসাবাদ, লালন-দুদ্দু শাহ’র মানববাদের সমন্বয় হতে পারে আমাদের মুক্তির অনন্য হাতিয়ার। তবে এ কথা বলতেই হবে, এসব মনীষীর অর্জনের পেছনে একান্ত সহায় ছিল হাজার বছর লালিত বাংলার বৌদ্ধ-উর্বর, সুফি-উর্বর, বৈষ্ণব-উর্বর সমাজমন। আড়াই হাজারেরও বেশি বছর আগে জন্মগ্রহণকারী গৌতম বুদ্ধের জীবনদর্শনে মানবতাবাদের যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা আজও প্রবাহমান।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮